১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এসেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাকে দেখে এগিয়ে আসেন ফিদেল কাস্ত্রো, কিউবার বিপ্লবী নেতা।
হাত বাড়িয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু, সে হাত উপেক্ষা করে তাকে জড়িয়ে ধরলেন ফিদেল। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই নেতা, সংগ্রাম ও ত্যাগ যাদের এক অভিন্ন সূত্রে আবদ্ধ করেছে। তাদের মুখচ্ছবিতে প্রস্ফুটিত যার যার জাতির স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর ফিদেল বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। তার ব্যক্তিত্ব ও সাহসের একমাত্র তুলনা চলে হিমালয়ের সঙ্গে। তাকে দেখেই আমি হিমালয় পর্বতমালা দেখার অভিজ্ঞতা পেয়েছি।
নব্বই দশকের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশে এই হিমালয়-সদৃশ মানুষটির প্রতি বাঙালি জাতি নানাভাবে তাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছে। গল্পে, কবিতায়, গানে, শিল্পীর তুলিতে, ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে নানাভাবে তাকে আমরা আবিষ্কার করেছি। এ তালিকায় সর্বশেষ যে গ্রন্থটি যুক্ত হল তার নাম ‘বঙ্গবন্ধু, এপিটোম অফ এ নেশন’, লেখক এনায়েতুল্লাহ খান। ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছে কসমস বুকস।
মোট ১৬৮ পাতার এ বইটি নানা দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী। বইটি ইংরেজিতে, ফলে অনুমান করি এর মূল লক্ষ্য বিদেশি পাঠক, যারা বাংলাদেশের জাতির পিতার জীবন ও তার কর্মের সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন।
কফি টেবিল বই হিসেবে মুদ্রিত এ বইটি লেখকের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি, কিন্তু শুধু কথা দিয়ে সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি নির্মিত হয়নি। এনায়েতুল্লাহ বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাসের আনুপুঙ্খিক বিবরণের বদলে সেই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন ছোট ছোট ঘটনা ও তার অলঙ্করণে ব্যবহৃত সুনির্বাচিত আলোকচিত্রের মাধ্যমে। এর মুদ্রণ, বাঁধাই, ছবির নির্বাচন ও সীমিত কথার ব্যবহার এতটাই সুচিন্তিত ও সৌকর্যমণ্ডিত যে একজন অনাগ্রহী পাঠককেও তা আকর্ষণ করবে।
মোট ২৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত গ্রন্থটিতে জাতির জনকের জীবনের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য অধ্যায় কথায় ও ছবিতে আলোকিত হয়েছে। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী, তার বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মার্চের ঘটনাক্রম, পাকিস্তানের কারাগারে তার অভিজ্ঞতা এবং ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রির বিবরণ।
এ গ্রন্থটিকে আরও বিশিষ্টতা দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাৎকার ও তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ড. কামাল হোসেনের একটি স্মৃতিচারণ। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যা ঠেকাতে ঘাতকের বুলেট নিজের শরীরে নিয়েছিলেন কর্নেল জামিল উদ্দিন আহম্মদ। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তার আত্মাহুতির একটি মর্মস্পর্শী বিবরণ পাঠককে আবেগাপ্লুত করে।
অধ্যায়গুলোর নির্বাচনের পেছনে সর্বদা কালানুক্রমিক অনুক্রম অথবা ঐতিহাসিক গুরুত্বের বদলে লেখকের ব্যক্তিগত আবেগ ও অগ্রাধিকার অনুসৃত হয়েছে। এর ফলে পুনরাবৃত্তির দুষ্টতা ছাড়াও দুর্বল সম্পাদনা গ্রন্থটিকে আহত করে।
গ্রন্থটির আসল শক্তি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চিত্রগুলো। ব্যবহৃত চিত্রগুলো অথবা তার অনুরূপ অনেক ছবিই আমাদের পরিচিত, কিন্তু কফি টেবিল সাইজের এই বইটিতে সেই ছবিই সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বইটির শুরুতে দুই পাতা জুড়ে, ২১ূ১১ সাইজের ছবিটতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের যে ছবিটি রয়েছে তার কথাই ধরা যাক।
সেদিন রেসকোর্সের মাঠে যারা সে ভাষণ শুনেছেন, বুকের মধ্যে সে দিনের উত্তেজনা, তার প্রতিশ্রুতির প্রত্যয়, আশায় ও উদ্বেগে থর থর সে কম্পন এখনও অমলিন। এ ছবিটি তার রাজসিক ব্যাপ্তিতে আবার সেই দিনটি ফিরিয়ে আনে। নতুন প্রজন্মের পাঠক অথবা যে কোনো বিদেশি বইটির পাতা উল্টাতে গিয়ে গিয়ে, তা দেখে আবেগাক্রান্ত হবেন। ৭ মার্চের পুরো ভাষণটির ইংরেজি অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সে আবেদন আরও সমৃদ্ধ হয়েছে, এ কথাও অনায়াসে বলা যায়।
এ রকম ছোট-বড় প্রায় ২০০ ছবি বইটিকে একটি প্রামাণ্য দলিলের মর্যাদা দিয়েছে। প্রতিটি ছবির পাশে তার চিত্রগ্রাহকদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকলে গ্রন্থটির দালিলিক চরিত্র পূর্ণতা পেত। গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে লেখক এ ত্রুটি শুধরে নেবেন, এ আশা রইল।
প্রচ্ছদে রয়েছে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা একটি তেল রঙ, যা এই গ্রন্থটিকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। শিল্পীর তুলিতে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর সেই আত্মপ্রত্যয়ী মুখাবয়ব, তার সাদা পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট, উত্থিত তর্জনী, এ সবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফিদেলের উক্তিটির যথার্থতাকে।
বাংলাদেশের সীমানায় হিমালয় পড়েনি, কিন্তু হিমালয়-সদৃশ এক মহামানব তার ইতিহাসকে আলোকিত করেছিল। এনায়েতুল্লাহ খানকে ধন্যবাদ, এ বইটির মাধ্যমে সেই মহামানবের জীবনকাব্যের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল।
বঙ্গবন্ধু, এপিটোম অফ এ নেশন
এনায়েতুল্লাহ খান প্রকাশক কসমস বুকস
পৃষ্ঠা ১৬৮ মূল্য ২,৫০০ টাকা