কে বেশি পিছিয়ে? উপার্জনক্ষম নারী নাকি উপার্জন অক্ষম নারী?
- by মজিবুল সুজন
- August 24, 2022
- 712 views
ছবিঃনূর হুমায়রা পিংকী। আবৃত্তিশিল্পি এবং ব্যাংকার
আমাদের দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে।যার অধিকাংশই নারী। ঘরে ঘরে এখন শিক্ষিত মেয়ে।
একজন নারী ঘরে বাইরে সমানভাবে কাজ করছে, উপার্জন করছে। সংসার এবং কর্মক্ষেত্র একই গতিতে নিয়ে ছুটছে। প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই ছোট বড় নানা পদে পুরুষের সাথে সমান তালে নারী তার আসন বজায় রেখে চলছে।
এত কিছু করেও কি নারী নির্যাতন কমেছে? নারীরা কি নির্যাতনের প্রতিবাদ করেন কিংবা করতে পারেন!নারী কি সত্যিই এগিয়ে গেছে বা যাচ্ছে?
প্রথমে শহুরে আধুনিক নারীর কথাই আলোচনা করা যাক। শিক্ষিত পরিবারগুলোতে কি নারী নির্যাতিত হয় না?হোক সে মানসিক কিংবা শারীরিক?
আমাদের দেশের শহরের কিংবা তথাকথিত আধুনিক পরিবারের মেয়েদেরও শুনতে হয় যে "তুমি মেয়ে,এটা তোমার কাজ না"।"তুমি মেয়ে তাই বিয়ের পর বাবার বাড়িতে আর কথা বলার অধিকার তোমার নেই"।"তুমি মেয়ে তাই তোমার রাত করে বাড়ি ফেরার অধিকার নেই"।প্রতিটি মেয়ের এই নেতিবাচক কথাগুলো শোনে বড় হতে হয়। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো এই কথাগুলো বেশিরভাগ সময় অন্য একজন মেয়েই বলে থাকে।
মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকালে গুঁজো হয়ে হাঁটতে একজন মেয়েই প্রথম শেখান।হোক সে মা অথবা নানী কিংবা দাদী।শারীরিক গড়নে পরিবর্তন এসেছে তোমার এখন নিজেকে গুটিয়ে চলতে হবে সেটাও একজন নারীই প্রথম শেখান।নারীদের এগিয়ে যাওয়ার প্রথম বাঁধা অন্য একজন নারীই হয়ে থাকেন।নারীদের প্রধান কাজ ঘর সামলানো সে শিক্ষাটা স্বজাতি দ্বারাই পায়।কর্মক্ষেত্রের কাজ সামলেও ঘরের সকল দায়িত্ব তারই, সব তাকেই দেখতে হবে সে দায়িত্ববোধ মায়েদের থেকেই পাওয়া। যেন রান্না-বান্না,সন্তানের সকল কাজ শুধুমাত্র নারীদের জন্যই নির্ধারিত।সেক্রিফাইস নামক শব্দটি শুধুমাত্র নারীদেরই সেটাও আমাদের মাসি/পিসিরাই শেখান।
দুজন পার্টনারই যখন কর্মজীবী তাহলে কাজ থেকে এসে ঘরের সকল কাজ ঝাঁপিয়ে পরে নারীকেই কেন করতে হবে!কারন তারা এখনও লাইফ পার্টনারকে স্বামীর আভিধানিক অর্থের জায়গাতেই মনে করেন।এখানেই তারা পিছিয়ে।Earning power and self-reliance are not the same thing.
এ যুগেও শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা মানসিক নির্যাতনের সাথে শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হয়।লোক লজ্জার ভয়ে শারীরিক নির্যাতন হজম করে ফেলেন।অনেকসময় তার শিক্ষা,পারিবারিক মর্যাদা এবং তার উপার্জনক্ষমতা নির্যাতনের কথা বাইরে প্রকাশ করতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
রাতে মার খেয়ে পর দিন হাসিমুখে সমাজে সুখী দাম্পত্যজীবন দেখাতে যেয়ে অনেক নারী নির্যাতনের কথা চেপে যান।একজন কর্মজীবী নারী চাইলেই এই নষ্ট সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। তবুও বেরিয়ে আসেন না,কেন বলেনতো?কারনটা কি লোকে কি বলবে?নাকি সন্তানের কথা ভেবে?আসলে সিদ্ধান্ত নিতেও তারা পিছিয়ে।এক্ষেত্রে যারা উপার্জন করছেননা তাদের কথা বলাই বাহুল্য।
পক্ষান্তরে,একজন উপার্জনঅক্ষম নারী বেশিরভাগ সময়ই নিজেকে সংসারের উচ্ছিষ্ট কিংবা অথর্ব মনে করে হিনমন্যতায় ভোগে। নিভৃতে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয় সংসারের কাজে।কখনও নিজের যোগ্যতা কিংবা উপার্জনক্ষমতাকে পরোখ করে দেখার সাধও তাদের জাগে না।কারন বেশিরভাগ সময় সংসার এর কর্তৃ হওয়ার লোভে ফেলে কিংবা সন্তানের ভবিষ্যতের দোহাই দিয়ে এদের আটকে দেয়া হয়।তবে বৌ এর বাজারে শিক্ষিত মেয়ের কদর বেশি।
শিক্ষিত বেকার বৌদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে স্বামীর টাকাই নিজের।অথচ এই বোকা নারীদেরই নিজের হাত খরচার জন্য প্রতিনিয়ত স্বামীর কাছে হাত পাততে হয়।অনেকে স্বামীর টাকা নিজের মনে করে বীরদর্পে খরচা করে গর্বিত হচ্ছেন নিজেকে ধনী লোকের বৌ ভেবে।দিন শেষে নিজের দাসত্বের মানসিকতার জয় ঘটিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে পতির গায়ের তলায়।
উপার্জনে অক্ষম একজন নারী তো বেরিয়ে আসার কথা কল্পনাতেও ভাবতে পারে না।সর্বপ্রথম আসে তার পারিবারিক চাপ। আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত,নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবা-মা মেয়ে হলে বিয়ে দেবার জন্য মুখিয়ে থাকে,কখন মেয়ে মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে সেদিনের আশায় দিনগুনে।বিয়ে দেবার পর মনে করেন ঝামেলা শেষ হলো।বিদায় করা ঝামেলা পুনরায় ঘরে আনতে তারা কখনও চাননা।এরকম পরিবারগুলোতে জন্ম থেকেই শেখানো হয় স্বামী মানে প্রভু,অভিভাবক।পতি দেব চাইলেই কারনে অকারনে শাষণ করতে পারবেন।শাস্তি সরূপ শরীরে আঘাত করার অধিকারও নাকি তাদের রয়েছে।
তবে বিংশ শতাব্দীতে এসে অনেক নারী এসব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এসে স্বাধীন জীবনযাপন করছে।উপার্জনের যোগ্যতা অর্জনের পাশাপাশি আত্মসম্মান নিয়েও বাঁচতে শিখছে।মেরুদন্ড শক্ত করে নিজের ভার বইতে শিখছে। নিজের চুলের কেমন কাট হবে সিদ্ধান্ত নিতে শিখছে। নিজের ফ্যাশন সৌন্দর্য নিজে ঠিক করতে শিখছে।
মোট কথা উপার্জনে সক্ষমতাতেই নারী মুক্তি কথাটি একেবারেই ঠিকনয়।নারী মুক্তির প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার।সেটা হোক শহুরে কিংবা গ্রামীণ।আমার ঘরের কণ্যা শিশুটি বড় হয়ে নিজের পরিচয়ে বাঁচবে নাকি অন্যের পরিচয় ধারন করবে সেটা আমাকেই ঠিক করতে হবে।উপার্জনে অক্ষম একজন নারীর গর্ভেই জন্মাতে পারে একজন উপার্জনক্ষম নারী।সবাই নিজের জীবনের সকল ব্যার্থতাকে নারী জাগরণী শক্তিতে রূপান্তরিত করে অন্য নারীর সহায়ক হয়ে উঠি।
"সে যুগ হয়েছে বাসি, যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো,নারীরা আছিল দাসী"।
লেখকঃ নূর হুমায়রা পিংকী, আবৃত্তিশিল্পি এবং ব্যাংকার।