অত্যাসন্ন করোনা সুনামি ও আইভারমেকটিন

কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে টোকিও আসার ফ্লাইটে, আমার সামনের সীটের যাত্রী নারিতা এয়ারপোর্ট পিসিআর পরীক্ষায় করোনা পজিটিভ হলো। পরবর্তীতে আমাকে ফোনে আরো সাবধান করা হলো, কারণ ভাইরাসটি ছিলো অতিসংক্রামক ভ্যারিয়ান্ট। পরবর্তী চৌদ্দদিন সেলফ  কোয়ারান্টাইন সময়টায় উদ্বিগ্ন ছিলাম। আল্লাহর রমতে কোন উপসর্গ ছাড়াই  কোয়ারান্টাইন পার হয়। তবে আমার মনে হয়েছে, দীর্ঘ ছয় ঘন্টা কোভিড-১৯ রোগীর ঠিক পিছনে বসে থেকেও আক্রান্ত না হবার পিছনে হয়তো আইভারমেকটিন এর একটি প্রতিরোধী ভূমিকা থাকতে পারে । আমি মাসে একবার একটি আইভারমেকটিন ট্যাবলেট (১২ মিলিগ্রাম) সেবন করি, কোভিড-১৯ প্রতিরোধক হিসাবে।  

উকুন, চুলকানি, কৃমির জন্য ব্যবহৃত অত্যন্ত সস্তা ঔষধ আইভারমেকটিন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে কতটা  সক্ষম তা নিয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে, হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত WHO তার সপক্ষে তেমন কিছু বলে নি। তবু আমার মতো অনেক চিকিৎসক  আইভারমেকটিনের করোনা প্রতিরোধ  সক্ষমতায় আস্থা রাখছে। এই সংকটকালে,  সেই আস্থার কারণটি সবার সাথে শেয়ার করছি। চূড়ান্ত বিচার-বিবেচনার দায়ভার পাঠকের।  

করোনা ভাইরাস SARS-CoV-2  সংক্রমণে কার্যকরি ঔষধগুলোকে মোটা দাগে, দুই ভাগে ভাগ করার যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে ভাইরাস কিলার, যেমন, রেমডিসিভির, ফাভিপিরাভির (পলিমারেজ ইনহিবিটর) । দ্বিতীয় ভাগে বাকী সব ঔষধ, যেগোলো সরাসরি ভাইরাস কিলার নয়, তবে ভাইরাস সংক্রমণজনিত প্রদাহ ও সাইটোকাইন ঝড় প্রতিহত করে। 

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ভাইরাস কিলার ঔষধগুলি খুব আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেখাতে পারেনি। অপরদিকে, যে ঔষধগুলো ভাইরাস কিলার নয় সেগুলোর উপরেও যে নিশ্চিন্তে আস্থা রাখা যায়, তা বলা যাচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে, আইভারমেকটিন ভাইরাস কিলার না হলেও তার মেকানিজম অফ এ্যাকশনে যে একটি স্বকীয়তা আছে, তা বলা যায়। 

SARS-CoV-2 ভাইরাসটি সচল কোন জীবাণু নয়। নিজে বেশ কয়েকটি প্রোটিন উৎপাদন করে এবং মানব দেহকোষের কয়েকটি ক্যারিয়ার ব্যবহার করে, ভাইরাসটি সংক্রমণ ঘটায়। এর মধ্যে ভাইরাসটির নিজের তৈরী স্পাইক প্রোটিনটি মানবদেহের ফুসফুসের কোষে ঢোকার জন্য একটি হুক হিসাবে কাজ করে। কোষের ভিতরে ঢোকার পর এটিকে কোষের সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম নামক একপ্রকার জালিকা  পর্যন্ত  বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই জালিকাতে গিয়েই ভাইরাসটি নিজে নিজে বংশবৃদ্ধি শুরু করতে পারে না। ভাইরাসটি তখন আর একটি ক্ষুদ্র প্রোটিন তৈরী করে, যেটি সংক্রমিত কোষের নিউক্লিয়াসে বহন করে নিয়ে যায় 'ইম্পোর্টিন' নামক একটি ক্যারিয়ার। ঐ ক্ষুদ্র  প্রোটিনটি কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবেশ হচ্ছে একটি সংকেত। সেই সংকেত অনুযায়ী নিউক্লিয়াস সাইটোকাইন নিঃসরণ ও ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটি সচল করে। এ পর্যন্ত গবেষণায় জানা গেছে, আইভারমেকটিন ঔষধটি 'ইম্পোর্টিন' নামক ক্যারিয়ারটির সাথে আবদ্ধ হয়ে সেটি নিস্ক্রিয় করে, যার ফলে নিউক্লিয়াসে ক্ষুদ্র প্রোটিনের সংকেতটি পৌঁছায় না এবং সাইটোকাইন নিঃসরণ ও ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়া সচল হয় না।  

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়ান্ট ( বি.১.৬১৭ ) এর বৈশিষ্ট, সম্পর্কে বলা হচ্ছে  এটি অতিমাত্রায় সংক্রামক। কথাটি দুইভাবে বিশ্লেষণ করা যায়। এক, এর স্পাইক প্রোটিনটির ধরণ পালটে গেছে, যে কারণে সহজেই ফুসফুসের কোষে ঢুকতে পারছে। দুই, এটি এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামে পৌঁছানোর পরে নিউক্লিয়াসে যে সাংকেতিক প্রোটিনটি প্রেরণ করছে তা আগের চেয়ে শক্তিশালী, যার ফলে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে আগের চেয়ে  দ্রুত গতিতে এবং সাইটোকাইন ঝড়টাও হচ্ছে প্রবল আকারে। 

এই পটভূমিকায় বলা যায়, আইভারমেকটিন ভাইরাস কিলার না হলেও তার মেকানিজম অফ এ্যাকশনের যে স্বকীয়তা আছে সেটা হয়তো অত্যাসন্ন করোনা সুনামী প্রতিরোধে কার্যকর হতে পারে।

Related Articles