এ্যাপল পার্কে আইফোনের ‘ডিজাইন ইন্জিনিয়ার’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু মাহিনের

প্রথম ছবিটি মার্কিন টেকনো জায়ান্ট এ্যাপলের হেড কোয়ার্টার ‘এ্যাপল পার্ক’। আমাদের ছোট ছেলে মাহিন ক্যালিফোর্নিয়ার কুপার্টিনো’র স্টিভ জবস এর সেই বিখ্যাত এ্যাপল পার্কে আইফোনের ‘ডিজাইন ইন্জিনিয়ার’ হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার সুযোগ পেয়েছে!

এ্যাপলের মত বিশ্বখ্যাত প্রতিস্ঠানে কাজ করার সুযোগ পাওয়া খুব সহজ বিষয় ছিলো না। কাজের প্রতি ওর নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং ওর বুদ্ধিদীপ্ততা ওকে এ পর্যায়ে আসতে সহায়তা করেছে। প্রতিটি পর্যায়ের সবকিছু মাহিন আমাদের সাথে শেয়ার করেছে। এ্যাপলের সাথে ওর পথচলার শুরুর গল্পটাই প্রথমে বলি-

আমরা তার জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেই নি। যন্ত্রকৌশল কিংবা কম্পিউটারের প্রতি অধিক আগ্রহের কারনে সেই ঠিক করে নিয়েছিল প্রকৌশলী হওয়ার। ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শাখার বিশ্বব্যাপী কদর আছে। গ্রেড এইট নাইনে থাকতেই সে ঠিক করে নিয়েছিল, এখানেই পড়বে সে। গ্রেড ইলেভেন টুয়েলভ এর ভাল ফলাফলে অবলীলায় সুযোগ পেয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং পড়ার।

ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়র পড়ার সুবিধা হলো প্রতি সেমিস্টার শেষে কো-অপ করার সুযোগ থাকে। মাহিন তার প্রথম সেমিস্টার শেষে কো-অপ করার সুযোগ পেয়েছিল গুয়েল্ফ এর হাইলিফ্ট তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘স্কাইজ্যাক’ নামক প্রতিস্ঠানে। দ্বিতীয় সেমিস্টার শেষে সে কো-অপ করেছিল পাশের শহর কেমব্রিজের লেক্সাস গাড়ি তৈরির প্রতিষ্ঠান টয়োটা মটর ম্যানুফ্যাকচারিং কর্পোরেশনের ইন্জিনিয়ারিং শাখার সাথে। তৃতীয় সেমিস্টার শেষে সে কো-অপ করতে গিয়েছিল টেক্সাসের অস্টিনে। সেখানে কো-অপ শুরু করেছিল অ্যাপেলের একটি ইন্জিনিয়ারিং টীমের সাথে। একমাস কো-অপ করার পর করোনা শুরু হলে চলে এসেছিল বাসায়। বাকী কো-অপ শেষ করেছিল বাসা থেকে। এরপর অস্টিনের সেই ইন্জিনিয়ারিং টীমের অনুরোধে আরও দু’টি কো-অপ সম্পন্ন করেছিল বাসা থেকেই। শেষ কো-অপের পর অস্টিনের ইন্জিনিয়ারিং টীমের ম্যানেজার মাহিনকে বলেছিল পড়াশুনা শেষ করে তাদের টীমে যোগ দেয়ার জন্য।

মাহিনের একাডেমিক কোর্স শেষ হবে এই এপ্রিলে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে সে যোগাযোগ করেছিল অস্টিনের সেই ম্যানেজারের সাথে। তিনি বলেছিলেন মাস ছয়েকের মধ্যেই তাদের একটি পদ খালি হবে। সে পদে তাকে ডাকা হবে। মাহিন সে পদের জন্য বসে থাকেনি। এ্যাপলসহ অন্যান্য শুন্যপদ খুঁজে খুঁজে আবেদন করেছে। মাহিনের বর্নিল অভিজ্ঞতার কারনে প্রায় সব জায়গা থেকেই ইন্টারভিউ এর ডাক পেয়েছে। এর মাঝে স্কাইপিতে পরীক্ষা দিয়েছে ইলনমাস্কের TESLA এবং SpaceEx এ।

এ্যাপল পার্ক থেকে আইফোনের ডিজাইন ইন্জিনিয়ারের ইন্টারভিউ এর ডাক যখন পায় তখন সে এটিকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছিল। ফোনে ইন্টারভিউ নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট শাখার ম্যানেজার। তিনি সন্তুষ্ট হয়ে আইফোনের একটা কম্পোনেন্টের উপর প্রজেক্ট তৈরির দায়িত্ব দিয়ে দুই সপ্তাহের সময় বেঁধে দেয়। ছেলের এপ্রিল মাসে ফাইনাল পরীক্ষা। সে পরীক্ষা নিয়ে তার নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। এর মাঝে এই দায়িত্ব। মাহিন দিনরাত খেটে সেই প্রজেক্ট তৈরি করে নির্ধারিত সময়েই জমা দেয়। 

দু’দিন পরেই ম্যানেজার জানায় মাহিনের তৈরি করা প্রজেক্ট তাদের পছন্দ হয়েছে এবং এ্যাপলের একটি ডিজাইন এক্সপার্ট টিম এই প্রজেক্ট নিয়ে তার সাথে আলোচনা করবে। নয় সদস্যের এই এক্সপার্ট টীমের সাথে আলোচনার সময় বেঁধে দেয় আট ঘন্টা। গত সপ্তাহের শুরুতেই মাহিন সেই ম্যারাথন ইন্টারভিউ শেষ করেছিল।

মাহিন আগেই বলে দিয়েছিল ইন্টারভিউয়ের দিন বাসায় কোন শব্দ করা যাবে না। রুমু আগের দিন রান্না করে ফ্রিজে তুলে রাখলো। বাসায় ওয়াশরুম রেনোভেশনের কাজ করছিল কন্ট্রাকটর, তাকে সেদিনের জন্য বিদায় করে দেয়া হলো। পুরো বাসায় একটা শীতল পরিবেশ বিরাজ করছিলো। 

চার ঘন্টা ডিশকাশনের পর মাহিন রুম থেকে বের হলো। আমরা বুঝলাম চতুর্মুখি প্রশ্নে ছেলেকে প্রায় বিধ্বস্ত করে ফেলা হয়েছে তবে সে বিচলিত নয়। সামান্য কিছু মুখে দিয়ে এককাপ কফি নিয়ে আবার ঢুকে গেল রুমে। ইন্টারভিউ হচ্ছিল স্কাইপিতে। রুমু আর আমি নীচতলায় বসে ছেলের সাফল্য কামনায় দোয়া করছিলাম। মাহিন পরীক্ষা দিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেনি শুধু এটুকু বলে সন্ধ্যাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, হয়তো খানিকটা মন খারাপও ছিলো।

ঘুম থেকে পরেরদিন সকালে উঠে মাহিন আমাদের জানালো এ্যাপলের এক সিনিয়র ডাইরেক্টর এখন তার ইন্টারভিউ নিবে। এবার মাহিনকে আর তেমন বিচলিত মনে হলো না। তার মনে সাহসের এবং আশার একটি ভীত তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহেই মাহিন সে ইন্ট্রারভিউ শেষ করেছিল।

এ সপ্তাহের শেষে এসে এ্যাপল তাকে স্বাগত জানায় আইফোনের ডিজাইন ইন্জিনিয়ার হিসেবে। এ খবরে মাহিনের সাথে আমাদের মনেও বয়ে যায় আনন্দের বন্যা। ওয়ার্কপারমিট, আমেরিকায় দীর্ঘসময় অবস্থানের ভিসা এবং পাষ্টওয়ার্ক ভেরিফিকেশনের মত কাজগুলি সম্পন্ন করে তারা মাহিনকে জানাবে কবে থেকে সে তাদের সাথে যুক্ত হবে স্টিভ জবস এর অবস্মণীয় সৃষ্টি ক্যালিফোর্নিয়ার কুপার্টিনোর সেই এ্যাপল পার্কে।

মাহিন তার বড় ভাই মুহিবের (মুহিব ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর মেডিকেল স্কুলে পড়ছে) মত এতো মেধাবী না তবে ছোটবেলা থেকেই সে চৌকস। ছোটবড় সকলের সাথে মেশার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ওর মাঝে আছে। এই যে আমরা গুয়েল্ফের যে কমিউনিটিতে থাকি, সেখানকার গুডাগাড়া থেকে শুরু করে আশি বছরের বৃদ্ধ সবার সাথে মাহিনের চমৎকার সম্পর্ক। আমাদেরকে তারা খুব একটা চেনে না, তারা আমাদেরকে চেনে মাহিনের ‘প্রাউড প্যারেন্ট’ হিসেবে। দেশে উত্তরা পোস্টাল কোয়ার্টারে যখন থাকতাম, সেই কোয়ার্টারের ছোটবড় সবার সাথে মাহিনের ছিল এমনই সম্পর্ক।

২০১০ সালে আমরা যখন কানাডা আসি, আমাদের আসতে হয়েছিল লন্ডনের হিথরো হয়ে। বিমান ভ্রমণের পুর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও হিথরো এয়ারপোর্টের বিশালত্ব আমাদের খানিকটা পাজেল করে দিয়েছিল। তখন দশ বছরের মাহিন আমাদের পথ দেখিয়ে এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালের সঠিক গন্তব্যে নিয়ে গিয়েছিল। তখনই বুঝেছিলাম তার বুদ্ধি আর দুরদৃষ্টির প্রখরতা।

বাবা মা হিসেবে সন্তানকে ইথিক্যাল বা মানবিক বিষয়াবলীর আমাদেরই শিক্ষা দেয়ার কথা। কানাডিয়ান পরিবেশ এবং শিক্ষা তাদেরকে এতোটাই সমৃদ্ধ করেছে যে সেই বরং এসব বিষয়ে আমাদের শিক্ষাগুরু হয়ে উঠেছে। আমাদের বেসমেন্টে ভাড়া থাকে এক ক্যানাডিয়ান পরিবার। তাদের সুযোগ সুবিধার বিষয়ে মাহিন এতোটাই সচেতন যে আমাদের ব্যাঘাত করে হলেও তাদের চাহিদা সর্বাগ্নে পুরণ করে দেয়। শীতে সে যখন বাসায় থাকে, দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বাসার বরফ তো পরিস্কার করেই, আশেপাশে বয়স্ক যে পরিবারগুলো থাকে নিজ উদ্যোগে তাদের বরফও পরিস্কার করে দেয়।

আমরা হয়তো পুরো পরিবার দুরে কোথাও যাচ্ছি কিংবা ফিরছি। এসব ক্ষেত্রে বরাবরই ড্রাইভ করে মাহিন। রাস্তার পাশে এমারজেন্সি লাইট জ্বালিয়ে হয়তো কোন গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, মাহিন তার পিছনে এসে গাড়ী পার্ক করে ফেললো। আমাদের কিছু না বলে সেই লোকের সাথে দু’এক কথা বলে গাড়ী থেকে যন্ত্রপাতি বের করে সেই অসহায় লোকের গাড়ী ঠিক করার কাজে লেগে গেল। ভ্রমণজনিত কারনে আমরা হয়তো খানিকটা বিরক্ত কিন্তু তার এই পরোপকারিতার মনোভাবে মুগ্ধতা নিয়ে গাড়িতে বসে থাকি। একাডেমিক শিক্ষার কারনে গাড়ীর কাজ তার নেশা। তার নিজের গাড়ীসহ আমাদের গাড়ী এবং প্রতিবেশীদের গাড়ির কাজ সে হাসিমুখেই করে দেয়। এসব গুণের কারনে অনেকেই বাড়ি বয়ে এসে মাহিনের প্রশংসার কথা আমাদের কানে মধুবর্ষণ করে যায়।

আমাদের বাড়ীর পাশের শহর ওয়াটারলু। ক্যাম্পাসে থাকার ঠিকানা থাকলেও মাহিন মুলত থাকতো আমাদের সাথেই কিংবা সময়ে অসময়ে ড্রাইভ করে চলে আসতো। আমাদের সমস্ত দেখভালের দায়িত্ব তার। আমার আব্বাকে দেখতাম বাড়ীর ছোটবড় সব কাজ নিজে দায়িত্ব নিয়ে করতেন। আমি এখন বাবা, অফিসের কাজ ছাড়া আমাকে এমন কোন দায়িত্বই পালন করতে হয় না। সব দায়িত্ব মাহিন তুলে নেয় তার নিজের কাঁধে। এ যেন আমার জীবনে আরেক বাবার আবির্ভাব।

দেশের নিশ্চিত ভবিষ্যতকে ছেড়ে আমরা প্রবাসে এসেছিলাম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাত ধরে। সফলতা ব্যর্থতার খতিয়ান আমরা করতে যাই না। আমাদের দৃষ্টি ছিলো পরবর্তী প্রজন্মের উত্থানের দিকে। তাদের এই পথচলায় আমাদের কৃতিত্ব সামান্যই তবে সবচেয়ে বড় মানসিক সাপোর্ট দিয়েছে ওদের মা, যার কারনে আমিও হয়তো থেকে গিয়েছিলাম এই প্রবাসে। জীবন, জীবিকা, সন্তানের সাফল্য সবকিছু নিয়ে প্রবাসকে এখন আর পরবাস মনে হয় না। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে লালন করে আমরা এই প্রবাসেও তৈরি করেছি এক টুকরো বাংলাদেশ। লেখকঃ মুমিনুল আজম। সম্পাদনা র/ভূঁ। ম ২০২২০৩/০১

Related Articles