ভাগ্যিস, চিকিৎসক বলেছিলেন, চঞ্চলতা কাজে লাগাতে ফুটবল ধরিয়ে দিন-দি মারিয়ার

ছবি: সংগৃহীত

বল পায়ে তাঁকে দৌড়াতে দেখে প্রশ্নটি জেগেছে অনেকের মনেই, এই অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি সে পায় কোত্থেকে? একই সমস্যায় পড়েছিল তাঁর পরিবারও। ছোটবেলায় ছেলেটি হাঁটার আগেই যেন দৌড়াতে শিখেছিল! তিন বছর বয়সে বাসার মধ্যে যখন চলাফেরা করত, দৌড়ানো বলাই ভালো—আশপাশটা স্রেফ বিধ্বস্ত হয়ে যেত। কারণটা আপনার–আমার সবারই জানা। কিছু বাচ্চাই আছে এমন, যে বাসার মধ্যে যখন হাঁটবে, কীভাবে যেন ভাঙচুর করতে করতে সেটা দৌড়ানোয় রূপ নেয়! বাধ্য হয়েই ছেলেটির পরিবার তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস, সেই চিকিৎসক বলেছিলেন, চঞ্চলতা কমাতে কিংবা কাজে লাগাতে চাইলে ফুটবল ধরিয়ে দিন।

নইলে আনহেল দি মারিয়াকে কি পেত এই বিশ্ব! হ্যাঁ পেত; হয়তো অন্য কোনো পেশায়। কিন্তু পৃথিবীর আনাচকানাচ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা কোটি ভক্তের ‘অ্যাঞ্জেল’ কি হয়ে ওঠা হতো? আর্জেন্টাইনদের প্রিয় ‘এল ফিদেও’, কারও কারও চোখে আবার লিওনেল মেসির ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’—এসবের কোনো কিছুই হয়তো হয়ে ওঠা হতো না দি মারিয়ার। বুয়েনস এইরেসের মনুমেন্তাল স্টেডিয়ামে আজ আর্জেন্টিনা ও চিলি ম্যাচ শুরুর আগে সেই চিকিৎসককে হয়তো মনে মনে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অনেকেই। 

দি মারিয়ার অবশ্য তখন সেসব স্মৃতিচারণার ফুরসত ছিল না। ৩৬ বছর বয়সী এই ভদ্রলোককে যাঁরা চেনেন, ফুটবল মাঠে এত দিন দেখে এসেছেন—তাঁদের নিশ্চয়ই জানা আছে, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সঙ্গে যেকোনো সংশ্লিষ্টতায় তিনি আবেগে ভেসে যান। গোল করে কিংবা শিরোপা জিতে তাঁর চোখ দুটো হয়ে ওঠে রোজারিওর বহতা নদী। মনুমেনন্তালেও তাই হলো।

স্টেডিয়ামের জায়ান্টস্ক্রিনে যখন তাঁর ক্যারিয়ারের সোনালি সময়ের বিভিন্ন টুকরো দেখানো হচ্ছিল, গ্যালারিতেও অনেককে চোখ মুছতে দেখা গেল। দি মারিয়া তখন দুই কন্যা ও স্ত্রীকে শক্ত করে ধরে চোখের নদে বান ঠেকানোর চেষ্টায় মত্ত। কিন্তু পারলেন কোথায়! আবারও ব্যর্থ। তাঁর চোখের পাড় ভেঙে গড়িয়ে পড়েছে বিন্দু বিন্দু জল, কেউ কেউ বলেন, সেসব ফোঁটার রংও আকাশি–সাদা। দি মারিয়া এতটাই আর্জেন্টাইন! 

আর তাই শৈশবের সেই অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি ফিরে এসেছে ভরা যৌবনেও। বল পায়ে উইং চিরে দি মারিয়া দৌড় দেখে রক্তে নাচন ওঠেনি, এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া ভার। যুক্তরাষ্ট্রে গত জুলাইয়ে কোপা আমেরিকার ফাইনাল দিয়ে আর্জেন্টিনার হয়ে সেই দৌড় থামিয়েছেন দি মারিয়া। সম্ভবত বয়সের ভারে একসময় থামতে হয় বলেই থামিয়েছেন। বয়স ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ না করলে ১১ নম্বর জার্সি কি তিনি ছাড়তেন?

জাতীয় দলের জন্য মাঠে সর্বস্ব নিংড়ে দেওয়া মানুষটি পারলে প্রাণটাও দিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন বহুবার। কিন্তু মাঠে স্বেচ্ছায় তো আর এসব দেওয়ার নিয়ম নেই। থাকলে হয়তো আজ দি মারিয়াকে দেখা যেত না! রসিকতা নয়, আকাশি–সাদার প্রতি দি মারিয়ার ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতেই এমনটা কথা বলা। তবে সেই গভীরতারও তল আছে, সবকিছুরই যেমন থাকে, যেমনটা আছে পৃথিবীর গভীরতম হ্রদ বৈকালেরও।

আকাশি–সাদা রঙের এক অদৃশ্য জলাধারের তল ছুঁয়ে ফেলার পর দি মারিয়া আজ মাঠে তাই আর দৌড়াতে পারেননি। পরিবারের সঙ্গে হেঁটেছেন গুটি গুটি পায়ে। আর করতালি দিয়েছে গোটা গ্যালারি, গোটা পৃথিবীও নয় কি? সেই পৃথিবীর মানুষ আগেই জেনেছে, আর্জেন্টাইনরা তাঁদের সোনার ছেলেকে ভিনদেশে বিদায় জানাতে চায়নি। তাই কোপা আমেরিকা জয়ের পরের ম্যাচেই মানে আজ সেই আয়োজনটা করা হয়েছিল।

আর্জেন্টিনা–চিলি ম্যাচ শুরুর আগে লিওনেল স্কালোনির দল গা গরম শুরু করার আগে দুই কন্যা পিয়া ও মিয়া এবং স্ত্রী হোর্হেলিনা কারদোসোকে নিয়ে মাঠে ঢোকেন দি মারিয়া। পরনে জিন্স, কেডস এবং হুডি। মুখটা কেমন শক্ত। মাঝেমধ্যেই ভ্রু কুঁচকাচ্ছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল, চোখের নদে ভ্রুর চাপে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) সভাপতি ক্লদিও তাপিয়া মাঠে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, দি মারিয়া সেখানে যেতেই জায়গা ছেড়ে দিলেন।

এরপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হলো। করতালির বন্যা বইল এবং জায়ান্টস্ক্রিনেও দি মারিয়ার ক্যারিয়ারের টুকরো টুকরো অংশের ভিডিও দেখানো হলো। ‘ফ্রম ওয়ান অ্যাঞ্জেল টু অ্যানাদার’ নামের এই ভিডিওতে তাঁর ক্যারিয়ারকে বর্ণনা করলেন তাঁরই বড় মেয়ে মিয়া; যেন এক দেবদূতকে আরেক দেবদূতের বার্তা! 

বিশ্বকাপ ফাইনাল, কোপা ফাইনাল, অলিম্পিক ফাইনাল, ফিনালিসিমায় গোল করে দি মারিয়ার কান্নার সেই মুহূর্তগুলো ভিডিওতে সবাই আবার দেখলেন। চোখ মুছলেন। দি মারিয়া পারছিলেন না, কী দিয়ে চোখ মুছবেন, হাত দুটো দিয়ে যে পরিবারকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছিলেন। সুখ–দুঃখে কিংবা প্রচণ্ড আবেগের মুহূর্তে পরিবারই তো শেষ সহায়। কেউ কেউ জানতে চাইতে পারেন, তখন তাঁর দুই কন্যার কেমন লেগেছে?

উত্তর হলো, বাবার কোনো কাজের জন্য গোটা স্টেডিয়াম থেকে যদি ভালোবাসা ও সম্মান উপচে পড়ে, গোটা পৃথিবী যদি কুর্নিশ করে, তখন সন্তান হিসেবে কেমন লাগে—সেই প্রশ্নটি নিজেকে করাই শ্রেয়। ভাষার কী ক্ষমতা যে এই অনুভূতিকে ধারণ করে! সজল কিন্তু বিস্ফোরিত নেত্রে তাঁরা দেখেছেন অনেকবার দেখা সেসব মুহূর্ত। তবু কি আঁশ মেটে? মেটে না। কারণ, যে খেলাটা বাবার জীবন, সে খেলায় তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ভালোবাসার জায়গাটি ছেড়ে দেওয়ার লগ্ন পৃথিবীর কোনো সন্তানের জন্যই স্বস্তিদায়ক নয়।

বুকে কেমন সুখের ব্যথা বাজে! দি মারিয়া মাইক্রোফোন হাতে সেই সুখের ব্যথায়ই যেন কথা বলতে পারছিলেন না। ধরে আসা গলায় বললেন, ‘কথা বলার জন্য সময়টা কঠিন। ভেতরে অনেক কিছুই তোলপাড় হচ্ছে। আমার সতীর্থ, কোচেরা এবং এএফএতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। কয়েক প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।

আর এ দলটার তরুণদেরও ধন্যবাদ জানাই, যারা আমাকে সবকিছু জেতার সুযোগ করে দিয়েছে।’ এটুকু বলে কিংবদন্তি কান্না আর ধরে রাখতে পারেননি। ‘বাজে সময়ে’ পাশে থাকার জন্য পরিবারকে ধন্যবাদ জানিয়ে দি মারিয়া তারপর বললেন সবচেয়ে কঠিন কথাটি—আমি এখন শুধুই ভক্ত! অথচ একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনা দল। সবার গায়েই ১১ নম্বর জার্সি। বয়সের বিশ্বাসঘাতকতায় তবু কত দূরে, তা–ই না! দি মারিয়ার এই বিদায়ী সংবর্ধনায় অন্য মহাদেশ থেকে একজন বিশেষ দর্শকও ছিলেন।

সুদূর মায়ামি থেকে তিনি ভিডিও বার্তা পাঠিয়েছেন আর্জেন্টিনা দলে ১৬ বছর ও ১১৩ ম্যাচের সতীর্থ দি মারিয়ার জন্য। চোটে না পড়লে এ ম্যাচটা হয়তো তিনি খেলতেন। পারেননি বলেই লিওনেল মেসির এই ভিডিও বার্তা, জায়ান্টস্ক্রিনে যা দেখানো হয়, ‘আমি দুঃখিত। তোমার জন্য এই বিশেষ রাতে এখানে থাকতে পারলাম না। পরিবার এবং ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে আশা করি তুমি রাতটা উপভোগ করবে।

তুমি যা দিয়েছ, এমন সম্মাননাই প্রাপ্য। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, একে অপরকে আমাদের যা যা বলার ছিল সবই বলেছি। সৌভাগ্যজনকভাবে একটি বছর (পিএসজিতে) আমরা ড্রেসিংরুম ভাগাভাগি করতে পেরেছি। জাতীয় দলে আমরা এত সবকিছুর মধ্য দিয়ে যাব, এত কিছু পাব, তা কে ভেবেছিল! আমরা সবকিছু জিতেই থেমেছি। মুহূর্তটা উপভোগ করো, কারণ এটা তোমার প্রাপ্য।’ দি মারিয়াকে জিজ্ঞেস করলে আবেগ দমক ঠেকাতে না পেরে শিশুসুলভ আবদারের বশে হয়তো বলবেন, এটা নয়, আর্জেন্টিনার জার্সিটা আমার প্রাপ্য, সম্ভব হলে যত দিন বেঁচে আছি তত দিনই!

কিন্তু মনুমেন্তালের স্পিকারে বাজছিল আর্জেন্টিনার গায়ক আবেল পিন্তোসের ‘নো মি ওলভিদেস’। বাংলায় এই গানের শিরোনামের অর্থ—আমাকে ভুলো না! সেই মুহূর্তটি অন্য চোখে দেখলে এটাও মনে হতে পারে, দি মারিয়ার সময় শেষ বলেই তাঁকে ভুলে যাওয়ার লগ্ন শুরু আর সে জন্যই সুরে সুরে এই আর্তি। কিন্তু সবকিছু ভুলিয়ে দেওয়ার সাধ্য তো সময়েরও নেই। সব জাতির কাছেই কিছু স্মৃতি, কিছু মানুষ চিরকালীন। আর্জেন্টিনায়ও তেমনি ওমর শিভোরি, ওরেস্তে করবাত্তা থেকে ডিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা লিওনেল মেসিরা সময়কে হার মানিয়েছেন। দি মারিয়াও তা–ই। 

কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ তো! গানটি যখন স্পিকারে ভেসে আসছিল, দি মারিয়ার হয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তাঁর ছলছল টলমল চোখ দুটি। লাইনগুলো যে বুকে তিরের ফলার মতো বিঁধে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কয়েকটি লাইন বাংলায় এমন, ‘বিদায়ের এই লগ্নে আমি আহত আবারও/ একবার বুকে জড়িয়ে ধরো/ জানতাম না আজ রাতেই সেই লগ্ন...যে তোমাকে সত্যিই চায় তাকে তোমরা অবশ্যই খুঁজে পাবে/ কিন্তু আমাকে ভুলো না!’

শরীরের রক্তের রং লাল কিন্তু মনের রক্তক্ষরণের কি রং আছে? থাকলে দি মারিয়ার সেই রংটাও আকাশি–সাদা। এমন মানুষকে ভুলবে কীভাবে আর্জেন্টিনা। সূত্র: প্রথম আলো/ স/হ/ন 06/09/2024

Related Articles