নরসুন্দর এবং করোনা

প্রফেসর ড. জি.এম. শফিউর রহমান,  চেয়ারম্যান,  ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ,  রা.বি.। 


নরসুন্দর বা নাপিতকে  ছোটবেলা থেকে কমবেশি সবারই চিনি। কেউ ভয়ে, কেউ ভয়কে জয়ে। তাদের ছাড়া যে চলেই না এটা করোনাকালে বুঝতে পেরে অনেকেই নিজ নিজ বাসায় নাপিতগিরি করেছেন, যেমন বউ কেটেছে বরের চুল, বাবা কেটেছে ছেলে মেয়ের চুল। আবার এই চুলকাটার চুলময় ছবি ভাইরাল হয়ে ছেয়ে গিয়েছিলো ফেসবুকের পাতার পাতা । যাহোক এটা বলা যায় যে বাংলার ঘরে ঘরে নাপিতের জন্ম হয়েছিলো।

আমি আজ নাপিত স্মরণে কিছু লিখবো।  স্কুলে  আমাদের সাথে  এই সম্প্রদায়ের কিছু ছেলে মেয়ে পড়তো।  তাদের নামের শেষে শীল পদবী যুক্ত থাকতো, যেমন পরেশ শীল, মদন শীল, কালাচাঁদ শীল। স্কুল জীবনের শেষে যদিও কেউ আর এ পেশায় জড়ায়নি। এলাকার অনেক শিক্ষিত শীল বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে টাংগাইল শাড়ির ব্যবসায়ী হয়েছেন। এবার বাড়ি গিয়ে দেখলাম আমার স্কুলের সবচেয়ে সুন্দর, স্মার্ট  জীতেন শীল বাজারে বেশ বড় ওষুধের দোকান দিয়েছেন, এর আগে দেখতাম উনি রাজশাহীতে টাংগাইল শাড়ীর ব্যবসা করতেন। শীলদের ব্যবসা বদলের কথা জিজ্ঞেস করতেই দাদা বললেন,  শীল পেশায় আর শিক্ষিতরা যেতে চায় না, যদিও অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিতরা যায় তবু প্রতিযোগিতায় তারা টিকতে পারছে না। প্রতিযোগিতা আবার কাদের সাথে?  উত্তরে দাদা বললেন দেখোনা নাপিতের পেশা তো আর শীল সম্প্রদায়েরই নেই, এতে যুক্ত হয়েছে মুসলমানরা, বিহাররীরা। তার বেশী পূজি নিয়ে আধুনিক সেলুন করেছে, চুল কাটছে,সেভ করছে উন্নতভাবে। তাই অল্পপূজি নিয়ে আমাদের গরীব হিন্দু শীল সম্প্রদায়ের এখন টেকাই মুসকিল। কি এখন বুঝলে,দাদার কথার মন্ত্রনা মনে একটু যান্ত্রনা বাড়ালো, সত্যিই তো!! এভাবেই  নানান  কঠিন বাস্তবতায়  পেশাচূত্য হয়ে যাচ্ছে তারা !!

মনের মধ্য উকি দিলো ছোট বেলার কথা, ছাত্রজীবনের, কলেজ - ইউনিভারসিটি লাইফের স্ম্রতি। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় আব্বার সাথে বাজারে যেতাম, একটি টিনের ঘরে টুল পেতে বসতো দশ পনেরজন নাপিত।  আব্বা তার পরিচিত নাপিতের নিকট বসিয়ে দিতেন, আর একটু ইশারা করে চলে যেতেন। সাথে সাথে নাপিত বেটা কাচি দিয়ে এমনভাবে  খচাতকরে চুল কেটে দিতো যে হাত দিয়ে দেখতাম মাথার চুল একেবারেই ছোট হয়ে গেছে। কান্না করতাম, চোখের জল পরার সাথে সাথে তার চুল কাটাও চলতো। চুলকাটা শেষ হলেও জল পরা শেষ হতো না!  নাপিত কাকা বলতেন কাদো কেনো, তোমার বাপই তো বলে গেলো” দাদা চুলগুলো তোমার  মাথা শুধু আমার “!! 


কলেজ জীবনে একটু উন্নত ব্যবস্থা, চুল কাটতাম টাংগাইল শহরে ভিক্টোরিয়া রোড়ের একটি সেলুনে, যতন শীল , রতনশীল দুই ভাই, স্টার নাপিত। তাদের দোকানে ভীড় লেগেই থাকতো। তাদের সেলুনে নাকি নায়ক মান্না, অমিত হাসান চুল কাটেন। এটাতে  তাদের ভীষন গরবো। তারা আবার সেলুন সমিতি বা শীল সমিতির  নেতা।  নেতাভাব  থাকলেও একটু শিক্ষিত বিধায় ব্যবহারও ভালো ছিলো। এখন আর  তাদের সেলুন সেখানে নেই। প্রথম প্রেমের মতো তাদের খুজি,কিন্তু পাইনা।

টাংগাইল শহরের প্যাড়াডাইসপাড়া রোড বা আমঘাট রোডের সেলুনে  মাঝে মধ্যে চুল কাটলেও আড্ডাটাই বেশী হতো, কারন নিউজ পেপার পড়ার অভ্যাস।  সেলুনে  রাখা পেপার পড়তে প্রায়ই যেতাম, প্রতিটি পাতাই খুটে খুটে পড়তাম। তাছাড়াও এদিক সেদিক যাবার সময় সেলুনে একটু টু মারতাম চুল চিরুনি করার জন্য।

টাংগাইলের কুমুদিনী সরকারী মহিলা কলেজের গেটে কোন সেলুন ছিলোনা, কিন্তু অদূরেই বংগবীর কাদের সিদ্দিকীর বাসার রাস্তায় একটা সেলুন ছিলো।  এই কলেজের সামনে প্রথম প্রেমঘটিত করানে প্রায়ই যেতাম, আপেক্ষার প্রিয় জায়গাটা ছিলো সেই সেলুন। কিন্তু ১৯৮৯ সালে কলেজের সংসদ ইলেকশন, আমরা বন্ধুরা কলেজের সামনে আড্ডা দিচ্ছি, ইলেকশন উপভোগ করছি।  ওমা এর মাঝেই এক বন্ধু এসে বললো, মেডিক্যাল কলেজের এডমিশন টেষ্ট এর রেজাল্ট হয়েছে,তুই চাঞ্চ পেয়েছিস। আমি বললাম তাই?  ও বললো  তোর রোল  ৫০৫ না!  আমি বললাম হ্যা।  তাহলে ঠিকই আছে, আমি পেপারে দেখে এসেছি। বন্ধুরা সবাই নিয়ে এলো সেই সেলুনে, উল্লাস  নিয়ে বলছে  দাদা পেপারদেন, ও মেডিকেল এ চাঞ্চ পেয়েছে। তাই! আপনারা মিষ্টি নিয়ে আসেন বলে নাপিতদাদা বাংলার বাণী  পেপার এগিয়ে দিলো। উচ্ছাসে পাপারটি নিয়ে দেখি আমার চাঞ্চ হয়নি, সমস্ত উল্লাস হাওয়ায় উড়ে গেলো ।। মানে ৫০৫ রোল ঠিকই আছে, কিন্ত  আমার রোল এস,এম, সি ৫০৫ এর জায়গায় ডি,এম,সি ৫০৫ আছে। সেই থেকে সেই সেলুন, সেই কলেজ গেট ছেড়েছি! 


রাজশাহী ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময় হলে হলে সেলুন ছিলো, কিন্তু হলের সেলুনে সিরিয়াল পেতে খুবই সিরিয়াস হতে হতো, যত আগেই যাইনা কেনো নেতা, পাতি নেতা,  সিনিয়র বড়ভাইদের যথাযথ সম্মান দেখানোর জন্য নিজের সিরিয়াল অনেকের মতোই ত্যাগ করতে হতো। যদিও হলের পাশে, বাহিরেও সেলুন ছিলো।  মাদার বক্স হলের পাশে রেলষ্টেশন বাজারে এক সেলুনের স্টার নাপিত ছিলো  রাজ্জাক। সিরাজগঞ্জ থেকে এসে সেলুন দিয়েছিলো।  সেইরকম নামডাক তার, মুখ মধুরসে ভরপুর । দুই বউ নিয়ে সিরাজগঞ্জ আর রাজশাহীতে তার  দুই সংসার । রাষ্ট্র,  রাজনীতি, ক্যাম্পাসের  সকল বিষয় তার নখদর্পণে ছিলো । সে এখন অতীত, কালেক্রমে সে এখন হারিয়ে গেছে, রাবি ষ্টেশন বাজারে সেলুন আছে অনেকই, কিন্তু সেই রাজ্জাক আর নেই !



রা.বি. এর বিনোদপুর গেটে কয়েকদিন এক রসিক মুসলিম  নাপিত পেয়েছিলাম। নাম ভুলে গিয়েছি । বাচ্চাদের চুল কাটাতে,কখনো নিজের চুল কাটাতে যেতাম।  তাকে আর দেখিনা। একদিন খোজ নিলাম, শুনি ইউনিভারসিটিতে তার চাকুরী হয়েছে।বিনোদপুর গেটে অন্য একজন হিন্দু নাপিত পেলাম, বেশ দক্ষ, কিন্তু নেশায় নিয়মিত  যুক্ত থাকায় সেলুনে উপস্তিতি অনিয়মিত। এই কারনে, পাশের অন্য এক সেলুনে যাই, শিক্ষক হিসাবে খুব সম্মান করে। চুল কাটতেই শুরু করে গল্প, স্যার কি আর করবো আমার বাপদাদার অনেক জমি ছিলো, রুয়েট, ইউনিভারসিটি সব একুয়ার করে নিয়ে নিয়েছে।  দাদা বিনিময়ে কিছু টাকা পেয়েছিলো, কিন্তু বেশী টাকাই নেতারা দিবে দিবে বলে আর দেয়নি।  বাবাকে একটি চাকুরী দিতে চেয়েছিলো, তাও দেয়নি। কি আর বুলবো, কপাল খারাপ স্যার, তাইতো আজ সেলুনে কাজ করছি!!

Related Articles